

৬ এপ্রিল ভারতের কেরালার একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে নমুনা সংগ্রহ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। রয়টার্স
নভেল করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ভারতকে পথ দেখাচ্ছে দেশটির দক্ষিণাংশের রাজ্য কেরালা। বড়িতে বাড়িতে দুপুরের খাবার পৌঁছে দেয়া কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আইসোলেশন টেস্টিং কিওস্কের মাধ্যমে করোনাভাইরাস পরীক্ষার মতো ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতকে নেতৃত্ব দিচ্ছে এই রাজ্যটি।
এই কেরালাতেই ভারতের প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চীনের উহান থেকে আসা এক মেডিকেল শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। তখন থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সতর্কতা অবলম্বন করে কেরালা।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই চীন থেকে আগতদের জন্য কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করে প্রদেশটি।
মার্চের শুরুতে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসি’র একটি অনুষ্ঠানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং পূর্ববর্তী নিপা ও জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সময় ভারতের এই রাজ্যটির কার্যক্রমের সফলতা তুলে ধরা হয়।
কেরালায় এখনও পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩৬৪। ভারতের সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রাজ্যের তালিকায় এটি অষ্টম। তবে, কেরালাতেই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। শনিবার পর্যন্ত এই রাজ্যে ১২৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় রাজ্যটির এই সফলতা এখন সারাবিশ্বের আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে।
শুক্রবার ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কেরালার দৃঢ় পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কেরালার প্রশাসন “জোরদার নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা, রোগীদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজতে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা, অধিক সময় ধরে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা, সারাদেশ লকডাউনের পর হাজার হাজার শ্রমিকের আবাসন এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করেছে।”
কেরালা কি বাংলাদেশের জন্য করোনাভাইরাস মোকাবিলায় একটি অনুসরণীয় মডেল হয়ে উঠতে পারে?
দরকার নমুনা পরীক্ষায় গতিশীলতা
লকডাউন চলাকালে পৃথিবীর সব জায়গায় বৃহৎ পরিসরে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হচ্ছে। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধুমাত্র এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই কেরালাতে ১৩ হাজারেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে যা অন্ধ্র-প্রদেশ কিংবা তামিলনাড়ুর মতো বড় রাজ্যের চাইতেও বেশি।
এর পাশাপাশি অনেক দ্রুততার সাথে নমুনা পরীক্ষা সম্পন্ন করা এবং পুরো প্রক্রিয়াটিকে অনেক সহজ করে ফেলেছে কেরালা।
মহামারী বিষয়ক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী রবিবার পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রতি ১০ লাখে ভূটানে ১,৫১১ জন, পাকিস্তানে ১৯২ জন, শ্রীলংকায় ২১১জন, নেপালে ১৫২ জন ও ভারতে ১৩৭ জন মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
যেখানে প্রতি ১০ লাখে বাংলাদেশ মাত্র ৫০ জন মানুষের নমুনা পরীক্ষা করছে। এসব থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে আরও অনেক বেশি নমুনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
শারীরিক দুরত্ব, সামাজিক ঐক্য
সঠিক ও আগাম কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে কেরালা কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। মার্চের শেষে সমগ্র ভারত জুড়ে লকডাউন জারি হওয়ার আগেই এসব পদক্ষেপ নেয় রাজ্যটি।
এসব পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো, স্বাস্থ্যবিধি-সম্মত পূর্ব সতর্কতামূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার সুব্যবস্থা করা।
কেরালা রাজ্য সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানকার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি সঠিক ও গ্রহণযোগ্য কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা, স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানায়।
এর ফলে রাজ্যে অবস্থিত বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের সাথে তারা সফলভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং “শারীরিক দূরত্ব ও সামাজিক ঐক্য” স্লোগানের মাধ্যমে আক্রান্তদের থেকে রোগটি ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্ণবাদের সাথে যোগসূত্র থাকায় তারা “সামাজিক দূরত্ব” পরিভাষাটি বর্জন করেও সফল হয়েছেন।
রাজ্যে ফেরত আসা অভিবাসী
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানে বহুদিন থেকেই এই রাজ্যটির সুনাম থাকলেও সেখানকার উচ্চ শিক্ষিতদের একটি বড় অংশ বিদেশ কিংবা ভালো চাকরির অন্য রাজ্যে গমন করে থাকেন।
২০১৮ সালে নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় ও ভয়ংকর বন্যার ধাক্কা সামলে ওঠার সময়ও মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি হারিয়ে রাজ্যটিতে লাখ লাখ অভিবাসী প্রবেশ করেছিল।
এছাড়া কেরালা ভারতের অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদেরও অন্যতম গন্তব্য। লকডাউন জারি হওয়ার পর বিভিন্ন রাজ্য ও বিদেশ অভিবাসীরা কেরালায় ফিরে আসে। এই অভিবাসীদের সংখ্যা কেরালার মোট জনসংখ্যার ৫%। এতে নতুন করে আবার একটি সংক্রমণের পর্যায় তৈরি হয় যার সাথে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির অনেক মিল রয়েছে।
এতো মানুষের প্রবেশ রাজ্যটিকে আরও সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। তবে,কিছু বিতর্ক থাকলেও রাজ্যটি চলমান সংকটে অভিবাসী সংক্রান্ত জটিলতা সফলতার সাথে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। জানুয়ারির ২৬ তারিখ তারা একটি সমন্বয় কেন্দ্র চালু করে।
সময়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে কেরালা সরকার এমন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে যার মাধ্যমে দ্রুত আক্রান্তদের শনাক্ত করে আইসোলেশনে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। এই পদ্ধতি খুব কম সময়ের মধ্যেই সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে।
কম বাধা, কম খরচ, বেশি কার্যকরী
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সঠিক সমন্বয়, যোগাযোগ ও সংশয় দূর করতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে নিয়োজিত করে কেরালা সরকার।
একই সাথে সংক্রমণ রোধের উপযুক্ত ও স্থানভেদে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উপায় বার করতে রাজ্যের প্রতিটি এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের কঠোরতাও অবলম্বন করতে হয়েছে।
বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বাসিন্দাদের এই করোনাভাইরাস মহামারী ও এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। একই সাথে এই মহামারী রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও চিকিৎসা গ্রহণ এবং এটি নিয়ে আতঙ্কিত না হতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব
করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য কেরালা সরকার ১৮টি কমিটি গঠন করেছে যারা প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বৈঠকে বসে। তারাই প্রতিদিন কতজনকে পরীক্ষা করা হয়েছে, কোয়ারেন্টাইনে কতজন ও কতজনকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কেরালা সরকারের নেয়া এই পদ্ধতি ভারতের অন্যান্য রাজ্য ও পৃথিবীর অনেক দেশের চাইতে সুলভ, কার্যকরি ও কম বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
৩০ জানুয়ারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত করার পর, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি পরীক্ষা করা হলেও কেরালায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম।
কেরালা সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবশ্যই অনেক কিছু শেখার আছে, যদি তারা এভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে চান।